
ডায়াবেটিসের পরিচিতিঃ
আজকে ডায়াবেটিসের কারণ, লক্ষণ, প্রকার ও প্রতিরোধের সম্পূর্ণ গাইড আপনাদের মাঝে শেয়ার করবো। প্রথমে ডায়াবেটিসের পরিচিতি জেনে নিই। সাধারণভাবে ডায়াবেটিস, হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী (ক্রনিক) রোগ যেখানে শরীরের রক্তে শর্করার (গ্লুকোজ) মাত্রা অত্যধিক বেড়ে যায়। এই রোগটি তখনই হয় যখন প্যানক্রিয়াস (pancreas) যথেষ্ট পরিমাণে ইনসুলিন (insulin) উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয় অথবা শরীর ইনসুলিন সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না। ডায়াবেটিস: কারণ
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত, আর বাংলাদেশেও এটি এখন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ না করলে তা শরীরের জন্য বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করতে পারে যেমন হার্টের রোগ, কিডনি সমস্যা, পেটের রোগ, চোখের ক্ষতি ইত্যাদি সৃষ্টি করতে পারে।
নিচের পোস্টগুলো পড়ুন।
কিডনিতে পাথর হলে করণীয় ও চিকিৎসা।
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদঃ
১. টাইপ ১ ডায়াবেটিস
ডায়বেটিস হল অটোইমিউন রোগ, যেখানে দেহের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্যানক্রিয়াসের ইনসুলিন উৎপাদনকারী β-সেলস নষ্ট করে ফেলে। সাধারণত শিশু ও তরুণ বয়সীদের মধ্যে টাইপ ১ ডায়াবেটিস দেখা যায়।
এদের ক্ষেত্রে ইনসুলিন ইনজেকশন ছাড়া জীবন সম্ভব নয়।
২. টাইপ ২ ডায়াবেটিস
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি টাইপ ২ ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিসের প্রায় ৯০%)। টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ফলে শরীর ইনসুলিন ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারে না বা পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন হয় না। সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে হয়, তবে বর্তমানে কম বয়সীদের মধ্যেও ক্রমশ ডায়বেটিস বাড়ছে। তবে জীবনধারা পরিবর্তন ও ওষুধে টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
৩. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational Diabetes)
গর্ভকালীন সময়ে কিছু মহিলাদের রক্তে উচ্চ শর্করা দেখা দেয়। সন্তান ও মা উভয়ের জন্য ঝুঁকি থাকতে পারে। জন্মের পর সাধারণত এ ধরণের ডায়াবেটিস চলে যায়, তবে ভবিষ্যতে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে।
গর্ভাবস্থায় কোমর ব্যথার কারণ ও প্রতিকার।
ডায়াবেটিসের কারণঃ
- জেনেটিক কারণ: পরিবারের অন্য কারো ডায়াবেটিস থাকলে ডায়বেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।
- অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: অতিরিক্ত ওজন, বেশি ফাস্ট ফুড, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করলে।
- শারীরিক কার্যকলাপের অভাব: ব্যায়াম কম করা, হাটাহাটি ও দৌড়াদৌড়ি না করা।
- বয়স বৃদ্ধি: ৪৫ বছরের বেশি বয়সে এমনিতেই ডায়বেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
- অন্যান্য রোগ: উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগ, পেটের রোগ ইত্যাদি কারণে ডায়বেটিস হয় ।
ডায়াবেটিসের লক্ষণঃ
- ডায়বেটিস হলে অতিরিক্ত তৃষ্ণা (Polydipsia) পায়।ণ
- ডায়বেটিস লক্ষণে বারবার বা ঘনঘন প্রস্রাবের সমস্যা (Polyuria) দেখা দেই।
- অপ্রত্যাশিতভাবে শরীরের ওজন কমে যাওয়া
- ঘনঘন অতিরিক্ত ক্ষুধা (Polyphagia) লাগা
- সবসময় শরীরের মধ্যে ক্লান্তি ও দুর্বলতা
- চোখ অন্ধকার ও ঝাপসা দেখা
- শরীরের কোন অংশ কেটে গেলে ক্ষত সারতে দেরি হয়।
- হাত পা ঝনঝনে বা অসাড় অনুভব করে।
ডায়াবেটিস নির্ণয়ের পদ্ধতিঃ

- রক্তে গ্লুকোজ পরিমাপ (Fasting Blood Sugar Test): ক্ষুধার্ত অবস্থায় রক্তের গ্লুকোজ মাত্রা টেস্ট করা।
- HbA1c টেস্ট: গত ৩ মাসের গড় রক্তে শর্করার মাত্রা টেস্ট করা।
- ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (OGTT): নির্দিষ্ট পরিমাণ চিনি খাওয়ার পর রক্তে গ্লুকোজ পরিমাপ টেস্ট করা।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধঃ
- প্রতিদিন স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা।
- কম কার্বোহাইড্রেট এবং চিনিযুক্ত খাবার গ্রহণ করা।
- বেশি শাক সবজি, ফল, ও সম্পূর্ণ শস্য খাওয়া।
- তেল, তিল, ও ফাস্ট ফুড একেবারেই না খাওয়া বা কমানো।
- নিয়মিত বা সময় মতো খাবার গ্রহণ করা।
- প্রতিদিন নিয়মিত ব্যায়াম করা কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটাহাঁটি বা দৌড়াদৌড়ি করা।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে সবসময় খেয়াল রাখা ।
- ওষুধ সঠিকভাবে গ্রহণ করা।
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ বা ইনসুলিন নেওয়া।
- স্ব-পরামর্শে ওষুধ বন্ধ করবেন না।
- রক্তে শর্করার নিয়মিত পরীক্ষা করা।
- নিজেকে সচেতন রাখুন।
- নিয়মিত চেকআপ করান।
- ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করুন।
ডায়াবেটিসের জটিলতাঃ
- হৃদরোগ ও স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
- কিডনি ক্ষতি (নেফ্রোপ্যাথি) সাধন হয়।
- চোখের সমস্যা (রেটিনোপ্যাথি, অন্ধত্ব) দেখা দেই।
- পা ও পায়ের আঙ্গুলে সংক্রমণ ও আলসার হয় ।
- স্নায়ুর ক্ষতি (নিউরোপ্যাথি) সাধিত হয়।
FAQs (সাধারণ প্রশ্নোত্তর)
FAQs (সাধারণ প্রশ্নোত্তর)
প্রশ্নঃ ডায়াবেটিস কী?
উত্তর: শরীরে ইনসুলিনের অভাব বা কার্যকারিতার অভাবে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যাওয়াকে ডায়াবেটিস বলে।
প্রশ্নঃ ডায়াবেটিসের নিরাময় আছে?
উত্তর: টাইপ ১-এর স্থায়ী চিকিৎসা নেই; টাইপ ২ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
প্রশ্নঃ ডায়বেটিস টাইপ ১ ও টাইপ ২ পার্থক্য:
উত্তর: টাইপ ১-এ ইনসুলিন একেবারে থাকে না; টাইপ ২-এ ইনসুলিন থাকে কিন্তু কাজ করে না ঠিকমতো।
প্রশ্নঃ ডায়াবেটিস কি বংশগত?
উত্তর: হ্যাঁ, পারিবারিক ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বেশি।
প্রশ্নঃ ডায়াবেটিসের উপসর্গ কী?
উত্তর: ঘন ঘন প্রস্রাব, পিপাসা, ক্ষুধা, ওজন কমা, ক্লান্তি।
প্রশ্নঃ ডায়াবেটিসের খাদ্যাভ্যাস কোনগুলো?
উত্তর: কম কার্বোহাইড্রেট, বেশি ফাইবার ও শাকসবজি খেতে হয়।
প্রশ্নঃ ডায়াবেটিস হলে মিষ্টি খাওয়া যাবে?
উত্তর: খুব সীমিত পরিমাণে, রক্তে গ্লুকোজ দেখে।
প্রশ্নঃ ডায়াবেটিস হলে ভাত খাওয়া যাবে?
উত্তর: সীমিত পরিমাণে, ব্রাউন রাইস হলে ভালো।
প্রশ্নঃ ডায়াবেটিস হলে রোজা রাখা যাবে কি?
উত্তর: চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রাখা যেতে পারে।
প্রশ্নঃ ডায়াবেটিসে ব্যায়ামের ভূমিকা কি?
উত্তর: নিয়মিত ব্যায়ামে রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
প্রশ্নঃ ডায়াবেটিস হলে ইনসুলিন বাধ্যতামূলক?
উত্তর: টাইপ ১-এ প্রয়োজনীয়, টাইপ ২-এ অনেক সময় ওষুধে হয়।
প্রশ্নঃ ডায়াবেটিস ওষুধে কিডনি ক্ষতি করে?
উত্তর: সঠিক ডোজে কিডনি নিরাপদ; অনিয়মে ক্ষতি হতে পারে।
প্রশ্নঃ ডায়াবেটিস হোমিও/ভেষজ চিকিৎসা কেমন?
উত্তর: বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সীমিত; সতর্কতা দরকার।
প্রশ্নঃ রক্তে সুগার কখন মাপতে হবে?
উত্তর: নিয়মিত, বিশেষ করে সকালে খালি পেটে ও খাবার পর।
প্রশ্নঃ ডায়াবেটিসের কারণে কোন কোন রোগ হতে পারে?
উত্তর: হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, চোখ ও স্নায়ু সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্নঃ গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়?
গর্ভাবস্থায় হরমোনজনিত কারণে হয়; শিশুর জন্য ঝুঁকি।
প্রশ্নঃ শিশুদের ডায়াবেটিস হয়?
হয়, বিশেষত টাইপ ১; অতিরিক্ত প্রস্রাব, পিপাসা লক্ষণ।
প্রশ্ন: ডায়াবেটিস সম্পূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য?
উত্তর: টাইপ ১ ডায়াবেটিস এখনও নিরাময়যোগ্য নয়, তবে টাইপ ২ ডায়াবেটিস জীবনযাপন পরিবর্তন ও চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
প্রশ্ন: ডায়াবেটিস রোগীরা কি সম্পূর্ণ চিনিজাতীয় খাবার পরিহার করবেন?
উত্তর: না, পরিমিত পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করে চিনিজাতীয় খাবার গ্রহণ করা যায়।
প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে কি করবেন?
উত্তর: নিয়মিত ডাক্তার পরামর্শ গ্রহণ ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ খুব জরুরি।
উপসংহারঃ
ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ হলেও সঠিক যত্ন ও সচেতনতার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সুস্থ জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই বেশি বেশি সচেতন হন এবং নিজের সুস্থতা নিজেই নিশ্চিত করুন।