শুক্রবার, ২৪ মে, ২০২৪

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ১০ টি ছোটগল্প।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ১০ টি ছোটগল্প।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ১০ টি ছোটগল্প।

রবি ঠাকুরের ভক্ত সংখ্যা ভারত ও বাংলাদেশে অনেক। তাঁর লেখা আমি ভীষণ পছন্দ করি। তাঁর সকল সৃষ্টির মতো ছোটগল্পগুলোও এককথায় অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার। আসলে বাংলা ভাষায় ছোটগল্প তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর দেখানো পথেই পরবর্তী লেখকগণ হেঁটেছেন বা চেষ্টা করেছেন। যাইহোক, রবি ঠাকুরের ছোটগল্পের-সমালোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। আসলে আজকের ভিডিও এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো তাঁর বিখ্যাত ১০টি ছোটগল্প রচনার পেছনের কাহিনী বা কোন প্রেক্ষিতে এগুলো লিখেছিলেন তা নিয়ে আলোচনা করা। তো চলুন জেনে নেওয়া যাক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ১০টি ছোটগল্প রচনার ইতিহাস।   
   

১। পোস্টমাস্টারঃ 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য জমিদার পরিবারের অন্যতম সদস্য ছিলেন এই কথা সবারই জানা। কবি হলেও জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব থেকে রেহাই পাননি তিনি। আপনারা অনেকেই জানেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে তাঁর একটি কাচারি বাড়ি ছিল। এই বাড়িতে বসেই তিনি জমিদারী দেখাশোনা করতেন। যাইহোক, রবি ঠাকুরের অতি জনপ্রিয় একটি ছোটগল্প ‘পোস্টমাস্টার’। এই কাচারি বাড়ির একতলাতে একটা পোস্ট অফিস ছিল। সেখানকার পোস্টমাস্টার মহাশয়ের সাথে তাঁর প্রায় প্রতিদিন দেখা হত এবং তাদের মধ্যে অনেক কথা-বার্তা, গল্প-গুজব হত। কবিগুরু প্রায় প্রতিদিন দিনের বা রাতের কোন একটা সময় পোস্টমাস্টার সাহেবের সাথে কাটাতেন। মূলত এই পোস্টমাস্টার মহাশয়ের জীবনের নানা কাহিনী অবলম্বনেই তিনি এই গল্পটি লেখেন। “একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, ‘ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সংগে করিয়া লইয়া আসি’-...ফিরিয়া ফল কি’ এই লেখাটুকু এতই মর্মস্পর্শী যে চোখে পানি এসে যায়।

২। কংকালঃ

ছোটবেলায় কবি যে ঘরে শুতেন সেখানে একটা মেয়ে মানুষের skeleton ঝুলানো ছিল। সে সময় তাঁর তেমন একটা ভয়-টয় করত না। পরিণত বয়সে একদিন বাড়িতে অতিথি সমাগম হওয়াতে তাকে বাইরে শোবার দরকার পরেছিল। অনেকদিন পরে সেই ঘরে তিনি আবার শুয়েছেন। শুয়ে তাঁর মনে হতে লাগল, সেজের আলোটা ক্রমে কাঁপতে কাঁপতে নিভে গেলো। তাঁর আরও মনে হতে লাগল, কে যেন মশারির চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বলছে ‘আমার কংকালটা কোথায় গেল’, ‘আমার কংকালটা কোথায় গেল’? ক্রমে মনে হতে লাগল সে দেয়াল হাতড়ে বন বন করে ঘুরতে আরম্ভ করেছে। এভাবেই তাঁর মাথায় এসে গেল এই ‘কংকাল’ গল্পটা।

৩। জীবিত ও মৃতঃ

কবিগুরুর ভোররাতে উঠে অন্ধকার ছাদে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল। তেমনি একদিন রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে যেতেই তিনি উঠে পড়লেন, ভেবেছিলেন উঠার সময় হয়েছে, আসলে তখন গভীর রাত। অভ্যাশবসতঃ তিনি হাঁটতে লাগলেন। সব ঘরের দরজা বন্ধ। সব একেবারে নিরব, নিঝুম। খানিক পড়েই ঢং ঢং করে দু’টো বাজার ঘন্টা পড়ল। তিনি থমকে দাঁড়ালেন, ভাবলেন-তাই তো, এই গভীররাত্রে আমি সারা বাড়িময় এমন করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাত তাঁর মনে হল তিনি যেন প্রেতাত্বা, এ বাড়ি haunt করে বেড়াচ্ছেন। তিনি যেন মোটেই তিনি নন, তাঁর রুপ ধরে বেড়াচ্ছেন মাত্র। এই idea টাই তাকে পেয়ে বসল, যেন একজন জীবিত মানুষ সত্যসত্যই নিজেকে মৃত ব’লে মনে করছে। এভাবেই জীবিত ও মৃত গল্পের সৃষ্টি।


৪। ছুটিঃ

এটাও শাহজাদপুরে কাচারিবাড়ি বসে লেখা তাঁর আর একটি অনবদ্য ছোটগল্প। তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম বাহন ছিল নৌকা। তিনিও নৌকাযোগেই তাঁর কাচারি বাড়িতে তাঁর জমিদারী দেখাশুনা করতে আসতেন। এমনি একদিন ওই রকম নৌকা ঘাটে ভিড়িয়েছেন। নদীর তীরে গ্রামের অনেক ছেলে খেলা করতে এসেছে। তার মধ্যে সর্দার গোছের একটি ছেলে ছিল। অনেক ডানপিটে স্বভাবের ছিল সে। তার কাজই হলো, এ-নৌকা ও-নৌকা করে বেড়ানো, মাঝিদের কাজ দেখা, মাস্তলের পাল গোটানো দেখা ইত্যাদি। তীরে অনেকগুলো গুড়িকাঠ গাদা-করা অবস্থায় ছিল। মাঝে ছেলেটি তড়াক করে নৌকা থেকে এই কাঠগুলি গড়িয়ে গড়িয়ে নদীতে ফেলতে আরম্ভ করলে। কিন্তু তার আমোদের পথে একটা বিঘ্ন এসে উপস্থিত হল। একটি ছোট মেয়ে এসে গুড়ি চেপে বসল। ছেলেটি তাকে উঠাবার চেস্টা করলে, কিন্তু মেয়েটি তা গ্রাহ্যও করলে না। তখন ছেলেটি তাকে সুদ্দই গুড়িটি উলটে দিলে। মেয়েটি পড়ে গিয়ে বিকট কান্না জুড়ে দিলে, এবং কাঁদতে কাঁদতে উঠেই ছেলেটিকে কষে এক চড় লাগালো। এই ঘটনা থেকেই ‘ছুটি’-র শুরু। সৃষ্টি হলো অন্যতম সেরা একটি গল্পের। এই গল্পে ফটিকের ‘ছুটি’ হয়েছিল চিরতরে।

৫। সমাপ্তিঃ

শাহজাদপুরে বসে লেখা তাঁর আর একটি অনবদ্য সৃষ্টি। (আমার অতি প্রিয় একটি ছোটগল্প; এই গল্পটি কলেজে পড়াকালীন সময়ে অসংখ্যবার পড়েছি আর ভেবেছি জীবনে মৃন্ময়ীর মত কোন মেয়ে যদি পেতাম! )। যাক, তাঁর কাচারি বাড়ির ঘাটে একটি নৌকা লেগে (ভিড়ে) আছে। এবং এখানকার ‘জনপদবধু’ তার সম্মুখে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। বোধহয় কাউকে বিদায় দিতে সবাই এসেছে। কিন্তু ওদের মধ্যে একটা মেয়ে আছে, তার প্রতিই রবীঠাকুরের মনোযোগটা সর্বাপেক্ষা আকৃষ্ট হচ্ছে। বার-তেরো বছরের স্বাস্থ্যবতী, একটু কালো অথচ দেখতে বেশ, ছেলেদের মত চুল ছাঁটা, বুদ্ধিমান এবং স্বপ্রতিভ ও সরল ভাবের একটি মেয়ে। একটা ছেলে কোলে করে এমন নিঃসংকোচে কৌতূহলের সঙ্গে কবিকে চেয়ে দেখতে লাগল। মেয়েটিকে ডেকে দু’একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু আবার কি ভেবে পারলেন না। মেয়েটি মাঝে মাঝেই আসত। যাইহোক, হটাৎ একদিন দেখা গেল, বধূবেশে শ্বশুরবাড়ি চলল সেই মেয়েটি। সেই ঘাটে নৌকা বাধা। কী তার কান্না! অন্য মেয়েদের বলাবলি কানে এল- ‘যা দুরন্ত মেয়ে! কী হবে এর শ্বশুরবাড়িতে! কবির ভারি দুঃখ হল তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া দেখে। চঞ্চলা হরিণীকে বন্দিনী করবে। ওর কথা মনেই করেই কবি লেখে ফেললেন ‘সমাপ্তি’ গল্পটি। খুবই রোমান্টিক ধাঁচের এই গল্পটি সুজোগ থাকলে পড়ে নিবেন (যারা এখনো পড়ে উঠতে পারেন নি)।

৬। ক্ষুধিত পাষাণঃ

কবির মতে, ‘ক্ষুধিত পাষাণের কল্পনা কল্পলোক থেকে আমদানি’। তবে তাঁর এই কল্পনার পেছনেও একটি কাহিনী আছে। কবি বিলেত যাওয়ার আগে তাঁর মেঝদাদার কর্মস্থল আহমেদাবাদ গিয়েছিলেন। তাঁর বড় ভাই জজিয়তি করতেন। আহমেদাবাদের জজের বাসা ছিল শাহিবাগে, বাদশাহী আমলের রাজবাড়ীতে। দিনের বেলায় তাঁর মেঝদাদা চলে যেতেন কাজে, তখন তাঁর মনে হত, বড়োবড়ো ফাঁকা ঘর হাঁ হাঁ করছে, সমস্ত দিন ভূতে পাওয়ার মতো ঘুরে বেড়াতেন তিনি। বাড়ির সামনে প্রকান্ড চাতাল, সেখান থেকে দেখা যেত সাবরমতি নদী (গল্পের ‘শুস্তা’ নদী)। তাঁর মতে, কোলকাতার মানুষ হিসেবে ইতিহাসের মাথা তোলা চেহারা কোথাও তিনি দেখেননি। আহমেদাবাদ এসে তিনি প্রথম দেখলেন চলতি ইতিহাস থেমে গিয়েছে, দেখা যাচ্ছে তার পিছন-ফেরা বড়োঘরোআনা। তাঁর সাবেক দিনগুলো যেন যক্ষের ধনের মতো মাটির নীচে পোঁতা। তাঁর মনের মধ্যে প্রথম আভাস দিয়েছিল ক্ষুধিত পাষাণের গল্প।

৭। দুরাশাঃ

টেনিসনের ‘Princess’ গল্পটি নাকি কয়েকজন বন্ধু মুখে মুখে রচনা করেছিলেন। একজন আরম্ভ করলে, খানিক দূরে অগ্রসর হয়ে আর-একজনকে বলতেন, এইবার তুমি গল্পটি চালিয়ে নাও; দ্বিতীয় ব্যক্তি থামলে আর-একজন গল্পটাকে আরো খানিকাটা অগ্রসর করে দিলেন-এই রকম করে যেন গল্পটি রচিত হয়েছে। কিন্তু আগাগোড়াই কবি লিখেছেন। তো অনেকের মন্তব্য কবির দুরাশা গল্পটা তেমনি। এ ব্যাপারে কবির বক্তব্য হলো, ‘দার্জিলিংয়ে একদিন কুচবিহারের মহারানী [সুনীতি দেবী] বলেলেন, ‘আসুন, সকলে মিলিয়া একটা গল্প রচনা করা যাক, আগে আপনি আরম্ভ করুন’। আমি আমাদের বাঙ্গালী সমাজ ছাড়া একটা romantic গল্পের অবতারণা করিবার প্রয়াসে বলিলাম ‘আচ্ছা বেশ’; এই বলিয়া আরম্ভ করিয়া দিলাম- ‘দার্জিলিংয়ে ক্যালকাটা রোডের ধারে ঘন কুজঝটিকার মধ্যে বসিয়া একটি হিন্দুস্থানী রমণী কাঁদিতেছে।’ এই বলিয়া ছাড়িয়া দিলাম। কিন্তু দেখিলাম, গল্পটা অন্যের মুখে অগ্রসর হইতে চাহিল না’ অগত্যা আমাকেই সমস্ত রচনা করিয়া লইতে হইল। এই রকম করিয়া আমার ‘দুরাশা’ গল্পটি রচিত হইয়াছে’।

৮। মাস্টারমশায়ঃ

এটাও যথারীতি কল্পনালোক থেকে আমদানি। একদিন কবি কুচবিহারের রানির আমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান। খাওয়া-দাওয়ার পর রানি কবির কাছে ভূতের গল্প শুনতে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। তার ধারনা রবিবাবু অবশ্যই ভুত দেখেছেন। অগত্যা তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, তবে একটা ঘটনা বলিতে পারি...’ তিনি শুরু করলেন তাঁর গল্প বলা। তাঁর বলা গল্পটি এমন চমকপ্রদ বা ভীতি জাগানীয়া ছিল যে রানি বলে বসলেন, ‘বলেন কি, সত্য নাকি?’ কবি হেসে বললেন, ‘না, মোটেই সত্য নয়, গল্প করিলাম মাত্র’। এই গল্পটি পরে নূতন করে লিখেছিলেন।


৯। কাবুলিওয়ালাঃ

"কাবুলিওয়ালা" অধ্যায়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গল্প যা আফগানিস্তানের একজন ফল বিক্রেতা মিনি এবং একটি কাবুলিওয়ালার মধ্যে বন্ধুত্বকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। রহমত নামে কাবুলিওয়ালা মিনির সাথে একটি বিশেষ বন্ধন তৈরি করে, তার সাথে তার নিজের মেয়ের মতো আচরণ করে। যাইহোক, অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির কারণে, রহমত একটি অপরাধের জন্য কারাগারে বন্দী। অনেক বছর পর, যখন সে মুক্তি পায়, তখন সে মিনিকে দেখতে যায়, যে এখন বড় হয়েছে। গল্পটি বন্ধুত্ব, নস্টালজিয়া এবং সময় অতিবাহিত করার বিষয়গুলি অন্বেষণ করে৷
 

১০। গিন্নিঃ 

এই গল্পটির অনেক সত্যতা আছে। সেটা কবির নর্মাল স্কুলের স্মৃতি হতে লিখিত। তাদের স্কুলে এক পন্ডিত ছিলেন যিনি ক্লাসের ছেলেদের অদ্ভুত নামকরণ করে ছাত্রদেরকে অনেক লজ্জা দিতেন। তার ভাষা এত কুত্সিত ছিল যে তার প্রতি অশ্রদ্ধাবশত কেউই কোন প্রশ্নের উত্তর করত না। যেমন একটি ছেলেকে তিনি ভেটকি বলে ডাকতেন, সে বেচারার গ্রীবার অংশটা কিছুটা প্রশস্ত ছিল।

সুপ্রিয় ভিউয়ারসগণ, আমি যে নিজে গবেষণা করে এসব বের করিনি এটা আপনারা ভাল করেই জানেন। কবির ছোট গল্পগুলোর একত্রিত সংস্করণ ‘গল্পগুচ্ছ’ থেকে সংকলন করে আমি তুলে দিয়েছি মাত্র। যে কোন ভুলের জন্য আগেই দুঃখিত বলে রাখছি। ভুল ধরিয়ে দিলে আরও খুশি হব। 

শেয়ার করুন

Author:

আমি একজন অতি সামান্য মানুষ। পেশায় একজন লেখক,ব্লগার এবং ইউটিউবার। লেখালেখি করতে খুব ভালো লাগে। আমার এই সামান্য প্রয়াসের মাধ্যমে মানুষের কিছু শেখাতে পারা ও বিনোদন দেওয়ার মাধ্যমে আনন্দ খুঁজে পায়।

0 coment rios: